বরেণ্য অভিনেতা ও আবৃত্তিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই। দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন ফেলুদা। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তার চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ণিল এক অধ্যায়ের সমাপ্ত হলো।
করোনাই যেন অনুঘটকের মতো সৌমিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেল না-ফেরার দেশে। তবে অনেকরকম জটিলতা দেখা গিয়েছিল শরীরে। ৪০ দিন ধরে কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে ছিলেন তিনি। গত ২৪ অক্টোবর রাত থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। রোববার সকালে হাসপাতাল থেকে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়।
চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জি নিউজ জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন সৌমিত্র। চিকিৎসায় স্বাভাবিক নিয়মে করোনামুক্তও হয়েছিলেন। কিন্তু শরীরে থাকা বার্ধক্যজনিত নানা রোগের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠছিলেন না। ফলে দীর্ঘদিন লাইফ সাপোর্টে থাকতে হয়েছে তাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। বুধবার বিকেলের পর থেকেই চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর, ব্রেনডেড হয়ে মৃত্যু হয় তার।
তিনদিন আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচার সফলও হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকঠাক কাজ করছে। তবে তিনি খুব দুর্বল। শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচারের পর সৌমিত্রকে প্লাজমা থেরাপিও দেওয়া হয়েছিল।
এর আগে গত ৬ অক্টোবর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর ১৪ অক্টোবর অভিনেতার কোভিড-১৯ রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। কিন্তু কোভিড এনসেফেলোপ্যাথির কারণে তার স্নায়ুতে প্রভাব পড়ে। এরপর থেকেই প্রায় অচেতন ছিলেন তিনি। মাঝে কয়েকদিন চোখ মেলে সাড়া দিচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ আবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। রোববার দুপুরে এলো তার মৃত্যুর খবর।
দর্শক নন্দিত এ অভিনেতা জীবনের বেলাশেষে চলে গেলেন অতল মৃত্যুর আহ্বানে। বাঙালি হারাল এ সময়ের এক অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে। প্রায় সাত দশকের দীর্ঘ ফিল্ম-ক্যারিয়ার সৌমিত্রের। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ দিয়ে শুরু তার অভিনয়জীবন।
নাট্যশিল্পী হিসেবেও তিনি বিশিষ্ট। তার কর্মজীবন অবশ্য শুরু হয় আকাশবাণীতে, ঘোষক হিসেবে। পরে বাচিক শিল্পী হিসেবেও তিনি ছাপ রাখেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রকবিতা বা জীবনানন্দ আচ্ছন্ন করে কবিতারসিক বাঙালিকে। কবিতা আবৃত্তি শুধু নয়, নিজে কবিতা রচনাও করেছেন তিনি। করেছেন পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। তবে তিনি মূলত অভিনেতাই। বাঙালির অন্যতম প্রিয় নায়ক।
১৯৩৫-এর ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় জন্ম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। জীবনের প্রথম ১০টা বছর সৌমিত্র কাটিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরে। তাঁর দাদার নাটকের দল ছিল। বাড়িতে নাট্যচর্চার পরিবেশ ছিল। ছোটবেলা থেকেই নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সৌমিত্র ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে হঠাৎ একদিন মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখার সুযোগ হয় তাঁর। সেদিনই জীবনের মোড় ঘুরে যায় তাঁর। তিনি পুরোদস্তুর নাটকে মনোনিবেশ করেন।