জেনে নিন ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও করণীয়, ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ে যেসব পরীক্ষা করা হয়

1312

ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত অসুস্থতা। যা বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে ঘটে। সাধারণত বাংলাদেশে গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে এই রোগটি দেখা যায়। ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত একটি সংক্রামক রোগ যা ডেঙ্গু ভাইরাসের (A.Aegyti ভাইরাস) কারণে হয়। এডিস নামক এক ধরনের মশার কামড়ে এ রোগ হয়। ডেঙ্গু জ্বর হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত বিস্তৃত উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। হালকা ক্ষেত্রে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা এবং ফুসকুড়ি হতে পারে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণঃ

ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাধারণত চার থেকে সাত দিনের মধ্যে, অথবা ৩-১৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে।

১. সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে।

২. শরীরের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে মাথায়, চোখের পেছনে, হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।

৩. ডেঙ্গু জ্বরের আরেকটি অন্যতম ও প্রধান লক্ষণ হল বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব অনুভব হওয়া। অনেক সময় বমি তেমন না হলেও প্রচন্ড বমি ভাব হয়ে থাকে।

৪. পূর্বের মতো এই ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা এখন আর মূল ফ্যাক্টর নয়। তাই প্ল্যাটিলেট কাউন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কোন প্রয়োজন নেই। বিষয়টি চিকিৎসকের উপর ছেড়ে দেয়াই ভালো।

৫. শরীরে বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন : চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সাথে, রক্ত বমি, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে।

৬. শরীরে পানির মাত্রা কমিয়ে দেয় ডেঙ্গু জ্বর। বেশি তাপমাত্রার কারণে শরীরে পানি শুকিয়ে গেলে অনেক সময়ই শরীরে ফুইডের ঘাটতি দেখা দেয়।

৭. ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ত্বকে লাল লাল ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। সাধারণত ডেঙ্গু হওয়ার দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম দিনের মধ্যে ত্বকে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কিছু ক্ষেত্রে, ডেঙ্গু জ্বর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) নামে আরও গুরুতর আকারে অগ্রসর হতে পারে। এর ফলে শরিরের যে কোন জায়গা দিয়ে রক্তপাত হয়, প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্তনালি থেকে রক্তরস বা প্লাজমা নিঃসরণ ঘটে। এই ক্ষেত্রে দেরি না করে দ্রুত  চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

ডেঙ্গু মশা কামড়ানোর কতদিন পর লক্ষণ প্রকাশ পায়

ডেঙ্গু মশা কামড়ানোর পর লক্ষণ প্রকাশ পায় সাধারণত ৩-১৪ দিনের মধ্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পায় ৪-৭ দিনের মধ্যে। লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি)
  • মাথাব্যথা
  • মাংসপেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা
  • চোখের পিছনে ব্যথা
  • বমি বমি ভাব বা বমি
  • লালচে ফুসকুড়ি
  • ত্বক ফুলে যাওয়া
  • অস্থিরতা বা দুর্বলতা
  • রক্তপড়া

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলি সাধারণত ৫-৭ দিনের মধ্যে চলে যায়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে রোগটি গুরুতর হতে পারে এবং মৃত্যুও হতে পারে। যদি আপনি ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলি অনুভব করেন তবে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ে যেসব পরীক্ষা করা হয়

ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি, লালচে ফুসকুড়ি, ত্বক ফুলে যাওয়া, অস্থিরতা বা দুর্বলতা, রক্তপড়া ইত্যাদি।

ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করা হয়। রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিবডি বা ভাইরাসের DNA শনাক্ত করা হয়।

ডেঙ্গু জ্বরের জন্য যেসব পরীক্ষা করা হয় সেগুলি হল:

  • ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা: এটি একটি রক্ত পরীক্ষা যা ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে। এটি ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে সঠিক পরীক্ষা।
  • ডেঙ্গু আইজিএম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা: এটি একটি রক্ত পরীক্ষা যা ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের তৈরি অ্যান্টিবডি শনাক্ত করে। এই পরীক্ষাটি ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণের সনাক্তকরণে ব্যবহৃত হয়।

ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য উপরের পরীক্ষাগুলির পাশাপাশি, ডাক্তার রোগীর ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষাও করতে পারেন।

ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কত কম হলে বিপদজনক?

ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমে যায়। এতে অল্প আঘাত থেকেও রক্তপাত হতে পারে। প্লাটিলেট কমে গেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত, একজন সুস্থ মানুষের রক্তে প্রতি ঘনমিলিমিটারে ১৫০,০০০ থেকে ৪৫০,০০০ প্লাটিলেট থাকে। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যদি প্রতি ঘনমিলিমিটারে ২০,০০০-এর নিচে নেমে যায়, তাহলে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। যদি প্লাটিলেট আরও কমে যায়, সেটা যদি ১০,০০০-এর কম হয়, তাহলে রোগীর রক্তচাপ কমে যেতে পারে, শক হতে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে গেলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। ডাক্তার প্লাটিলেট বাড়ানোর জন্য ওষুধ বা রক্তদানের পরামর্শ দিতে পারেন। এছাড়াও, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে গেলে কিছু ঘরোয়া প্রতিকারও করা যেতে পারে, যেমন:

  • প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা
  • বিশ্রাম নেওয়া
  • জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন গ্রহণ করা
  • ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া

ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে সঠিক পরীক্ষা কোনটি?

ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে সঠিক পরীক্ষা হল ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা। এটি একটি রক্ত পরীক্ষা যা ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে। এন্টিজেন হল ভাইরাসের একটি প্রোটিন যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা সনাক্ত করা যেতে পারে। ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষাটি ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণের প্রথম কয়েক দিনে সবচেয়ে সঠিক।

ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য অন্যান্য পরীক্ষাগুলিও ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন ডেঙ্গু আইজিএম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা। তবে, এই পরীক্ষাগুলি ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণের পরেও ইতিবাচক হতে পারে, তাই ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে সঠিক পরীক্ষা হল ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা।

উপরের পরীক্ষাগুলির পাশাপাশি, ডেঙ্গু জ্বরের নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার রোগীর ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষাও করতে পারেন। যদি আপনি ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলি অনুভব করেন তবে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় করণীয়ঃ

১. জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল সেবন করতে হবে, দিনে সর্বোচ্চ ৪ বার।

২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।

৩. জ্বর কমানোর জন্য বার বার শরীর মুছে দিতে হবে।

৪. জ্বরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার, যেমন ওরাল স্যালাইন, ফলের জুস, শরবত ইত্যাদি পান করতে হবে।

৫. বমির কারণে যদি কোন রোগী পানি পান করতে না পারেন সেক্ষেত্রে স্যালাইন দিতে হবে।

৬. এ্যান্টিবায়োটিক, এ্যাসপিরিন বা অন্য কোন ব্যথানাশক ওষুধ একেবারেই সেবন করা যাবে না।

৭. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে আক্রান্ত হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করাতে হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা

ডেঙ্গু জ্বরের কোনো ভ্যাকসিন নেই, তবে সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য বেশ কিছু জিনিস করা যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • পোকামাকড় প্রতিরোধক ব্যবহার করে
  • লম্বা হাতা ও প্যান্ট পরা
  • মশারি ব্যবহার
  • মশা-আক্রান্ত এলাকা এড়িয়ে চলা

আপনি যদি মনে করেন যে আপনার ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে, তাহলে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিত্সা জটিলতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here