ইলন মাস্কের এক্স (পূর্বের টুইটার) কেনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুনিয়ায় একটা নতুন উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। অনেকেই এক্সের নীতিগত পরিবর্তন এবং বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে নতুন প্ল্যাটফর্ম খুঁজতে শুরু করেছেন। এই সময়েই আবির্ভূত হয় ব্লুস্কাই (bluesky) নামে একটি নতুন সোশ্যাল মাধ্যম। এটি এখন সামাজিক যোগাযোগের জগতে একটি উদীয়মান তারকা। ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ, ব্যক্তিগত এবং বিকেন্দ্রীকৃত যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এর উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং ব্যবহারকারীবান্ধব নকশা সামাজিক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
ব্লুস্কাই কী?
ব্লুস্কাই মূলত একটি বিকেন্দ্রীকৃত সোশ্যাল অ্যাপ যা টুইটারের সাবেক সিইও জ্যাক ডরসি ধারণা করেছিলেন। এটি টুইটারের মতোই ব্যবহারকারী ইন্টারফেস রয়েছে। ব্লুস্কাইয়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর অ্যালগরিদমিক পছন্দ, ফেডারেটেড ডিজাইন, এবং সম্প্রদায়-নির্ভর মডারেশন।
ব্লুস্কাই সোশ্যাল নিজস্ব উন্নত AT প্রোটোকল-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা একটি ওপেন সোর্স ফ্রেমওয়ার্ক। এর মানে হলো, প্ল্যাটফর্মটি কীভাবে তৈরি হচ্ছে এবং কী কী উন্নয়ন চলছে তা কোম্পানির বাইরের মানুষের কাছেও স্বচ্ছ।
ব্লুস্কাই বনাম এক্স এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম
ব্লুস্কাই দেখতে অনেকটাই টুইটারের মতো, তবে এটি বিকেন্দ্রীকৃত। এর মানে হলো, ব্যবহারকারীরা চাইলে ব্লুস্কাইয়ের নিজস্ব সার্ভারের পরিবর্তে অন্য কোনো সার্ভারে তাদের অ্যাকাউন্ট স্থানান্তর করতে পারবেন। এটি প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীলতা কমায় এবং ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতা বাড়ায়।
তুলনামূলকভাবে, মেটার থ্রেডসও উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে থ্রেডসের ২৭.৫ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারীর তুলনায় ব্লুস্কাইয়ের এখনো অনেক দূর যেতে হবে।
অন্যদিকে, মাস্টোডন (Mastodon) মতো প্ল্যাটফর্মগুলোও বিকেন্দ্রীকৃত হলেও, ব্যবহারকারীরা ব্লুস্কাইকে তুলনামূলকভাবে সহজ এবং ব্যবহারবান্ধব বলে মনে করেন।
কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্লুস্কাই জনপ্রিয় ?
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর ব্লুস্কাই একদিনেই ৮ লাখেরও বেশি নতুন ব্যবহারকারী অর্জন করে। নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত এই প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১.৬ কোটিতে। বর্তমানে দ্রুত গতিতে জনপ্রিয়তা লাভ করছে ব্লুস্কাই। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ্য এতে যোগ দিচ্ছেন।
যদিও দেখতে এটি অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মতোই। পাতার বাম দিকে একটি মেনু আছে যেখানে সার্চ, নোটিফিকেশন, হোমপেজ ইত্যাদি সুবিধাগুলো রয়েছে। এখানে ব্যবহারকারীরা পোস্ট করতে পারবেন, কমেন্ট করতে পারবেন, রিপোস্ট করতে পারবেন এবং তাদের পছন্দের পোস্টগুলো লাইক দিতে পারবেন। সহজ কথায়, এক্স বা পূর্বের টুইটার যে রকম ছিল, ঠিক সেই রকমই দেখতে ব্লুস্কাই।
এর জনপ্রিয়তার পেছনে বড় কারণ হলো ইলন মাস্কের এক্স-এর বিতর্কিত নীতি পরিবর্তন। ব্লক ফিচার বদলে দেওয়া এবং ব্যবহারকারীর পোস্টে তৃতীয় পক্ষের এআই প্রশিক্ষণের অনুমতি দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত অনেক ব্যবহারকারীকে এক্স ছেড়ে ব্লুস্কাইয়ের দিকে নিয়ে এসেছে।
ব্লুস্কাই তাদের ব্যবহারকারীদের ডেটা এবং অ্যাকাউন্টের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে। ব্যবহারকারীরা চাইলে তাদের নিজস্ব ডোমেইন নামকে ব্যবহারকারী হ্যান্ডেল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। যেমন: @username.bsky.social or @username.morningringer.com
এছাড়া, ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং টেইলর সুইফট ভক্তদের এক্স থেকে সরে যাওয়াও ব্লুস্কাইয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
ব্লুস্কাই কীভাবে ব্যবহার করবেন?
সাইন আপ করার পর ব্যবহারকারীরা একটি হ্যান্ডেল তৈরি করতে পারেন, যা @username.bsky.social নামে প্রদর্শিত হয়। ব্যবহারকারীরা চাইলে তাদের ডোমেইন নামও হ্যান্ডেল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
অ্যাপটি একটি সরলীকৃত টুইটারের মতো কাজ করে। ব্যবহারকারীরা ২৫৬ অক্ষরের পোস্ট তৈরি করতে পারেন, যেখানে ছবি যুক্ত করার সুবিধাও রয়েছে। পোস্টগুলোতে উত্তর দেওয়া, শেয়ার করা, লাইক দেওয়া বা রিপোর্ট করার অপশন আছে।
অ্যাপে একটি “হোম” টাইমলাইন রয়েছে যেখানে অনুসরণ করা ব্যক্তিদের আপডেট দেখা যায়। এছাড়া, একটি “ডিসকভার” ট্যাবের মাধ্যমে জনপ্রিয় পোস্ট এবং অনুসরণ করার মতো নতুন অ্যাকাউন্টের পরামর্শ পাওয়া যায়।
ব্যবহারকারীর প্রোফাইলেও টুইটারের মতো ফিচার রয়েছে—প্রোফাইল ছবি, ব্যাকগ্রাউন্ড, বায়ো, এবং অনুসরণকারীর সংখ্যা।
ব্লুস্কাই সোশ্যাল: অ্যান্ড্রয়েড, আইফোন এবং ল্যাপটপেও ব্যবহারযোগ্য
ডিজিটাল যুগে জনপ্রিয় ব্লুস্কাই সোশ্যাল এখন ব্যবহার করা যায় অ্যান্ড্রয়েড, আইফোন এবং ল্যাপটপে। এটি একাধিক ডিভাইসে সমানভাবে সাপোর্ট করে, যা ব্যবহারকারীদের জন্য আরও সহজ ও সুবিধাজনক।
- ১. অ্যান্ড্রয়েড:
অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্য ব্লুস্কাই-এর একটি ডেডিকেটেড অ্যাপ রয়েছে, যা গুগল প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করা যায়। অ্যাপটি ইন্সটল করে সহজেই সাইন আপ বা লগ ইন করে ব্যবহার শুরু করা যায়। - ২. আইফোন (iOS):
আইফোন বা আইপ্যাড ব্যবহারকারীদের জন্য অ্যাপল অ্যাপ স্টোর থেকে ব্লুস্কাই ডাউনলোড করা যায়। iOS প্ল্যাটফর্মের জন্য অ্যাপটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা, যা ব্যবহারকারীদের মসৃণ অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করে। - ৩. ল্যাপটপ/ডেস্কটপ:
যারা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তারা ওয়েব ব্রাউজারের মাধ্যমে ব্লুস্কাই সোশ্যাল অ্যাক্সেস করতে পারেন। এর ওয়েব ভার্সন মোবাইল অ্যাপের মতোই সহজ এবং কার্যকর।
ব্লুস্কাই সোশ্যাল এখন অ্যান্ড্রয়েড, আইফোন এবং ল্যাপটপ ব্যবহারকারীদের জন্য একটি ইউনিভার্সাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। আপনি যেখানেই থাকুন, যেকোনো ডিভাইস থেকে সহজেই যুক্ত হতে পারেন এই নতুন যুগের সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে।
ব্লুস্কাই মালিকানা: টুইটারের প্রতিদ্বন্দ্বী, নতুন নেতৃত্বে
যদি ব্লুস্কাই আপনার কাছে টুইটারের মতোই মনে হচ্ছে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই নতুন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছেন টুইটারের প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডোরসি। ২০১৯ সালে টুইটারে সিইও থাকা অবস্থায় ব্লুস্কাই নিয়ে কাজ শুরু করেন, এবং ২০২১ সালে টুইটার ছেড়ে যাওয়ার পর জ্যাক ডোরসি এটাকে নতুন একটি কোম্পানিতে পরিনত করেন। তার স্বপ্ন ছিল ব্লুস্কাইকে টুইটারের মতো একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত করা, যেখানে একজন ব্যক্তি বা কোম্পানি এর একচেটিয়া মালিক না হবে।
কিন্তু গত মে মাসে জ্যাক ডোরসি এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ান। সেপ্টেম্বরে তিনি তার অ্যাকাউন্টও ডিলিট করে দেন। বর্তমানে ব্লুস্কাই চালিত হচ্ছে প্রধান নির্বাহী জে গ্রেবারের নেতৃত্বে, যিনি একজন মার্কিন পাবলিক বেনিফিট কর্পোরেশন।
সহজ কথায়, ব্লুস্কাই হলো টুইটারের মতোই একটি সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম যেখানে ব্যবহারকারীরা মতামত ও তথ্য বিনিময় করতে পারেন। তবে এর সৃষ্টিকর্তা এবং বর্তমান নেতৃত্বের পরিবর্তনের কারণে এটি টুইটার থেকে কিছুটা আলাদা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্লুস্কাইয়ের অর্থায়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ব্লুস্কাই বিজ্ঞাপনমুক্ত থাকার জন্য বিকল্প অর্থায়নের পথ খুঁজছে। তারা কাস্টম ডোমেইন এবং প্রিমিয়াম ফিচার যুক্ত করার জন্য সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস চালু করেছে। জুলাই ২০২৩-এ, ব্লুস্কাই তাদের অর্থায়নে অতিরিক্ত তহবিল যোগ করেছে এবং ব্যবহারকারীদের জন্য কাস্টম ডোমেইনের সুবিধা চালু করেছে।
নভেম্বর ২০২৪-এ, ব্লুস্কাই ১৫ মিলিয়ন ডলারের সিরিজ এ তহবিল সংগ্রহ করেছে। তারা উচ্চ মানের ভিডিও আপলোড এবং প্রোফাইল কাস্টমাইজেশনের মতো প্রিমিয়াম ফিচার নিয়ে কাজ করছে। তবে তারা বিজ্ঞাপন এবং ব্যবহারকারীর তথ্য বিক্রির মাধ্যমে আয় করতে চায় না।
আসলে মূল কথা হচ্ছে, ব্লুস্কাই এখনো একটি উদীয়মান প্ল্যাটফর্ম, তবে এর সম্ভাবনা অনেক। ইলন মাস্কের এক্স-এর বিতর্কিত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ব্লুস্কাই একটি নতুন বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর বিকেন্দ্রীকৃত নকশা এবং ব্যবহারবান্ধব বৈশিষ্ট্য ব্যবহারকারীদের কাছে দারুণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
যদিও ব্লুস্কাইয়ের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাহ্য করা যায় না, তবে এটি দ্রুত উদ্ভাবনের মাধ্যমে সেই বাধাগুলো অতিক্রম করছে। যদি এটি তার স্বচ্ছ নীতিমালা এবং ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ প্রদান করার প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে পারে, তবে এটি ভবিষ্যতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন সংবাদ পোর্টাল টেকক্রাঞ্চ ও বিবিসি