Photo credit: canva

ঘুম আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের অভাব শরীরের কার্যকারিতা, স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগের উপর প্রভাব ফেলে। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য কতটুকু ঘুম প্রয়োজন তা নির্ধারণ করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা আন্তর্জাতিক গবেষণার ভিত্তিতে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা ও এর উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী বয়সভিত্তিক ঘুমের সময়সীমা:

ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন (National Sleep Foundation) -এর গবেষণা অনুযায়ী, বয়স অনুযায়ী ঘুমের চাহিদা ভিন্ন হতে পারে। বয়স অনুযায়ী ঘুমের প্রয়োজনীয় সময় নিচে দেওয়া হলো:

নবজাতক (০-৩ মাস):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ১৪-১৭ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য ঘুমের সময়: ১১-১৯ ঘণ্টা।
  • এটি সবচেয়ে বেশি, কারণ এই বয়সে শিশুরা দ্রুত বিকাশের পর্যায়ে থাকে এবং তাদের ঘুমের প্রয়োজনও বেশি।

শিশু (৪-১১ মাস):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ১২-১৫ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ১০-১৮ ঘণ্টা।
  • এই বয়সে, শিশুরা স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে শক্তি সংগ্রহ করে।

ছোট শিশু (১-২ বছর):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ১১-১৪ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ৯-১৬ ঘণ্টা।
  • শিশুরা চলাফেরা এবং কথা বলতে শেখা শুরু করে, ফলে ঘুম তাদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রিস্কুল (৩-৫ বছর):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ১০-১৩ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ৮-১৪ ঘণ্টা।
  • এই বয়সে শিশুরা শিক্ষা এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করে, তাই তাদের পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন।

স্কুল পড়ুয়া (৬-১৩ বছর):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ৯-১১ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ৭-১২ ঘণ্টা।
  • এই বয়সে শিশুদের একাডেমিক এবং মানসিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন।

কিশোর (১৪-১৭ বছর):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ৮-১০ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ৭-১১ ঘণ্টা।
  • এই বয়সে শারীরিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় ঘুম সুপারিশকৃত।

তরুণ (১৮-২৫ বছর):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ৭-৯ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ৬-১১ ঘণ্টা।
  • এই বয়সে কাজ এবং অধ্যয়নের চাপে ঘুমের গুরুত্ব অনেক।

বয়স্ক (২৬-৬৪ বছর):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ৭-৯ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ৬-১০ ঘণ্টা।
  • এই বয়সে মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন।

বয়স্ক (৬৫ বছর বা তার বেশি):

  • প্রস্তাবিত ঘুম: ৭-৮ ঘণ্টা।
  • গ্রহণযোগ্য সময়: ৫-৯ ঘণ্টা।
  • বৃদ্ধ বয়সে শরীরের শক্তি ধরে রাখার জন্য কম ঘুম প্রয়োজন।

প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঘুমের সময়ঃ

Journal of Clinical Sleep Medicine-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে রাতে ৭ ঘণ্টা ব তার কিছু বেশি সময় ঘুমানোকে স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর চেয়ে কম ঘুম অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে যেমন: স্মৃতিশক্তির হ্রাস, স্থূলতা, রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং হৃদরোগ। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।

পর্যাপ্ত ঘুমের উপকারিতা:
ঘুম আমাদের দেহের জন্য কতটা উপকারী হতে পারে তা নিচে ব্যাখ্যা করা হলো:

  • মানসিক চাপ কমায়: পর্যাপ্ত ঘুম মনকে প্রশান্ত করে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
  • স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে: ঘুম স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। Nature Reviews Neuroscience-এ প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, ঘুম আমাদের স্মৃতিশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: পর্যাপ্ত ঘুম দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। Journal of Experimental Medicine-এর গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে, কম ঘুমের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।

পর্যাপ্ত ঘুম না হলে কী কী ক্ষতি হতে পারে?
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এর কারনে অর্থেরও অনেক অপচয় হয়। এ বিষয়ে The Lancet-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ডিমেনশিয়া, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, এবং মাংসপেশী সম্পর্কিত অসুস্থতার মতো সমস্যা ছাড়াও কার্ডিওমেটাবলিক রোগ, যেমন টাইপ ২ ডায়াবেটিস, স্থূলতা, হৃদরোগ এবং মেটাবলিক সিন্ড্রোমের ঝুঁকি বাড়ায়। ঘুমের অভাব আমাদের শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা এবং চিকিৎসা খরচও বৃদ্ধি করে থাকে।

এ ছাড়া স্লিপ অ্যাপনিয়া এক ধরনের ঘুমের ব্যাধি, যেখানে ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসে বারবার বাধা আসে। এটি সাধারণত ঘুমের মধ্যে কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং প্রতি রাতে একাধিকবার ঘটতে পারে।

ঘুমের সমস্যা হলে কী করবেন?
যদি আপনার ঘুমের সমস্যা হয়, তাহলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তিনি আপনার সমস্যার কারণ নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা দেবেন। ঘুমের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসাপাতল রয়েছে। এর মধ্যে Dhaka Sleep Research Centre একমাত্র স্লিপ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। তারা স্লিপের সমস্যা নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

  • ঘুমের পরিবেশ: ঘুমের জন্য একটি শান্ত, অন্ধকার এবং ঠান্ডা পরিবেশ তৈরি করুন।
  • ঘুমের আগে: ঘুমের আগে কফি, চা, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
  • ঘড়ির দিকে তাকাবেন না: ঘুমের সময় ঘড়ির দিকে তাকালে আপনার ঘুম আরও খারাপ হতে পারে।
  • দিনে ঘুমাবেন না: দিনে যতটা সম্ভব ঘুম থেকে বিরত থাকুন।

ঘুমের স্বাস্থ্যকর রুটিন
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে কিছু স্বাস্থ্যকর রুটিন মেনে চলা যেতে পারে:

  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো এবং ঘুম থেকে ওঠা
  • ঘুমানোর আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস এড়ানো
  • ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল পরিহার করা
  • ঘরের পরিবেশ ঘুমের জন্য আরামদায়ক রাখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here