বায়ু দূষণ হলো পরিবেশে এমন সব ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি, যা মানুষের স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য, এবং পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সহজভাবে বলতে গেলে, আমরা যে বাতাস শ্বাস নিই তাতে যদি দূষক পদার্থ মিশে যায়, তা-ই বায়ু দূষণ। এই দূষণ আমাদের শ্বাসযন্ত্রে, ফুসফুসে, এমনকি হৃদযন্ত্রেও মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

বায়ু দূষণের কারণ

বায়ু দূষণের কারণ প্রধানত দুটি: প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট।

প্রাকৃতিক কারণ:

  • জ্বালামুখী অগ্নুৎপাত: অগ্নুৎপাত থেকে নির্গত ছাই ও গ্যাস (যেমন সালফার ডাইঅক্সাইড) বায়ুকে দূষিত করে।
  • ধূলিঝড় ও মরুভূমি: বাতাসে প্রচুর ধূলিকণা যুক্ত হয়।
  • বনভূমির আগুন: দাবানলের ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হয়।
  • সমুদ্রের লবণ: বাতাসে ক্ষুদ্র লবণকণা ভেসে বেড়ায়।

মানবসৃষ্ট কারণ:

  • যানবাহন: যানবাহনের ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, এবং সালফার ডাইঅক্সাইড মিশে বায়ুকে দূষিত করে।
  • শিল্প-কারখানা: কলকারখানার ধোঁয়ায় ভারী ধাতু এবং বিষাক্ত গ্যাস থাকে।
  • ইটভাটা ও নগরায়ণ: নির্মাণকাজ ও ইটভাটার ধোঁয়া বায়ুদূষণের বড় কারণ।
  • বর্জ্য পুড়ানো: প্লাস্টিক ও আবর্জনা পোড়ালে ডাইঅক্সিন ও ফিউরান জাতীয় ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়।
  • কৃষিকাজ: কীটনাশক ও সার ব্যবহারের ফলে মিথেন গ্যাস বাতাসে ছড়ায়।

বায়ু দূষণের মাত্রা এবং AQI

বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণ করতে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) ব্যবহার করা হয়। এটি বায়ুর গুণমান বোঝায় এবং স্বাস্থ্যের জন্য বায়ু কতটা ক্ষতিকর তা নির্ধারণ করে।

AQI মানস্তরস্বাস্থ্যের প্রভাব
০-৫০ভালো (Good)বাতাস বিশুদ্ধ ও নিরাপদ।
৫১-১০০সহনীয় (Moderate)গড়পড়তা মানের বাতাস; সংবেদনশীলদের জন্য হালকা ঝুঁকি।
১০১-১৫০অস্বাস্থ্যকর (Sensitive groups)শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
১৫১-২০০অস্বাস্থ্যকর (Unhealthy)সকলের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি।
২০১-৩০০খুব অস্বাস্থ্যকর (Very unhealthy)মারাত্মক স্বাস্থ্যপ্রভাব; বাইরে যাওয়া বিপজ্জনক।
৩০০+বিপজ্জনক (Hazardous)জরুরি ব্যবস্থা প্রয়োজন।

 

PM২.৫ এবং PM১০
বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে PM২.৫ ও PM১০।

  • PM২.৫: ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়েও ছোট কণা। এগুলো ফুসফুসে ঢুকে মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি করতে পারে।
  • PM১০: ১০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত বড় কণা, যা শ্বাসনালীতে আটকে যায়।
সময় (ঘণ্টা)PM২.৫ (µg/m³)PM১০ (µg/m³)
সকাল ৬টা৩৫৫০
সকাল ৯টা৪৫৬৫
দুপুর ১২টা৫৫৭৫
বিকেল ৩টা৬০৮৫
সন্ধ্যা ৬টা৭০9০
রাত ৯টা৮০১০০

 

বাংলাদেশের বায়ুদূষণের চিত্র:

ঢাকা শহর প্রায়ই বিশ্বের শীর্ষ বায়ুদূষিত শহরের তালিকায় আসে। শীতকালে PM২.৫ ও PM১০ এর মাত্রা অনেক বেড়ে যায়।
বিশেষ করে ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার কারণে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

বায়ু দূষণের প্রভাব

স্বাস্থ্যগত প্রভাব:

  • শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এবং ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি।
  • হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ।
  • শিশুদের বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে বাধা।

পরিবেশগত প্রভাব:

  • অ্যাসিড বৃষ্টি, যা মাটি ও জলাশয়কে দূষিত করে।
  • গাছপালার ক্ষতি এবং ফসল উৎপাদনে বাধা।
  • জলবায়ু পরিবর্তন: গ্রিনহাউস গ্যাস (যেমন কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন) বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।

বায়ুদূষণ প্রতিরোধে করণীয়

  • নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার: সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির প্রসার ঘটানো।
  • পরিবেশবান্ধব যানবাহন: বিদ্যুৎচালিত গাড়ি ব্যবহার।
  • গাছ লাগানো: বনভূমি সংরক্ষণ ও ব্যাপকভাবে গাছ লাগানো।
  • শিল্প-কারখানায় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: উন্নত পরিশোধন প্রযুক্তি ব্যবহার।
  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি: দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে জানানো।

বায়ুদূষণ আমাদের জীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এটি প্রতিরোধে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় স্তরেই উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বায়ুদূষণ কমানোর পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here